ওজন কমাতে মসুর ডালের ভুমিকা ও মসুর ডাল খাওয়ার উপকারিতা

মসুর ডাল হলো এক ধরনের ডাল যা বাংলাদেশ এবং ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে জনপ্রিয়। এটি উচ্চ প্রোটিন, আঁশ, আয়রন এবং অন্যান্য পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। সাধারণত এটি বিভিন্ন ধরনের খাবারে ব্যবহৃত হয় যেমন ডাল ভাত, স্যুপ, খিচুড়ি, এবং বিভিন্ন তরকারিতে।


মসুর ডাল রান্না করা খুব সহজ এবং এটি দ্রুত সিদ্ধ হয়, তাই অনেকেই এটি দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন।

সূচিপত্রঃ ওজন কমাতে মসুর ডালের ভুমিকা ও মসুর ডাল খাওয়ার উপকারিতা

মসুর ডালের মধ্যে কি কি উপাদান বিদ্যমান থাকে?

মসুর ডালে বিভিন্ন পুষ্টিগুণ সম্পন্ন উপাদান বিদ্যমান, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এর মধ্যে প্রধান উপাদানগুলো হলো:

১. প্রোটিন

  • মসুর ডাল প্রোটিনের ভালো উৎস, যা দেহের পেশি গঠনে এবং শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে।

২. কার্বোহাইড্রেট

  • এতে ধীরপাচ্য কার্বোহাইড্রেট রয়েছে, যা শক্তির প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে।

৩. ফাইবার

  • প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার থাকে, যা হজম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।

৪. ভিটামিন:

  • ভিটামিন বি১ (থিয়ামিন): স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
  • ফোলেট (ভিটামিন বি৯): গর্ভবতী নারীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ভ্রূণের সঠিক বিকাশে সাহায্য করে।

৫. খনিজ পদার্থ:

  • আয়রন: রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায় এবং অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে সহায়তা করে।
  • পটাসিয়াম: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • ম্যাগনেসিয়াম: হার্টের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং পেশির জন্য উপকারী।
  • ফসফরাস: হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য উন্নত করে।
  • জিঙ্ক: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।

৬. অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট

  • মসুর ডালে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান রয়েছে, যা শরীরকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে এবং বয়সজনিত ক্ষতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।

৭. স্বল্প ফ্যাট

  • মসুর ডালে অত্যন্ত কম ফ্যাট থাকে, যা হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

এই উপাদানগুলো মসুর ডালকে একটি পূর্ণাঙ্গ পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে গড়ে তুলেছে, যা নিয়মিত খাদ্যতালিকায় থাকা উচিত।

মসুর ডাল খাওয়ার উপকারিতা

মসুর ডাল খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে। এতে প্রচুর পুষ্টিগুণ রয়েছে, যা শরীরের বিভিন্ন অংশের জন্য উপকারী। মসুর ডালের কিছু প্রধান উপকারিতা হলো:

১. প্রোটিনের ভালো উৎস

  • মসুর ডাল প্রোটিনের একটি ভালো উৎস, যা শরীরের পেশি গঠনে সহায়তা করে। নিরামিষভোজীদের জন্য এটি একটি প্রোটিনের চমৎকার বিকল্প।

২. হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক

  • মসুর ডালে থাকা ফাইবার, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফোলেট হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এটি খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে সাহায্য করে।

৩. রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ

  • মসুর ডালে কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স রয়েছে, যা ধীরে ধীরে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপকারী, কারণ এটি ইনসুলিনের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে।

৪. হজমে সহায়তা

  • মসুর ডালের ফাইবার হজম প্রক্রিয়া ভালো রাখে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সহায়তা করে। এটি অন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করে।

৫. ওজন কমাতে সহায়ক

  • মসুর ডালে উচ্চ ফাইবার এবং কম ক্যালোরি থাকায় এটি পেট ভরাট রাখতে সাহায্য করে, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।

৬. আয়রনের ভালো উৎস

  • মসুর ডাল আয়রনের একটি ভালো উৎস, যা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়। আয়রনের ঘাটতির কারণে অ্যানিমিয়া হওয়া থেকে রক্ষা পেতে মসুর ডাল কার্যকরী।

৭. শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক

  • মসুর ডাল ধীরে ধীরে শক্তি সরবরাহ করে, কারণ এতে থাকা কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট দীর্ঘ সময় ধরে শক্তি প্রদান করে। এটি শরীরকে কর্মক্ষম রাখে।

৮. ত্বক এবং চুলের যত্ন

  • মসুর ডালে থাকা প্রোটিন এবং ভিটামিন বি ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে। এতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ত্বকের বার্ধক্য রোধে সাহায্য করে।

৯. হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্যের উন্নতি

  • মসুর ডালে থাকা ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং ম্যাগনেসিয়াম হাড় এবং দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষা করে, যা অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমায়।

১০. অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী

  • মসুর ডালে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান শরীরকে ফ্রি র‍্যাডিক্যালের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং বার্ধক্যজনিত ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে।

মসুর ডাল পুষ্টিতে সমৃদ্ধ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে সাহায্য করে, তাই এটি নিয়মিত খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত উপকারী।

মসুর ডাল খাওয়ার অপকারিতা

মসুর ডাল সাধারণত পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসাবে পরিচিত, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি খাওয়ার কিছু অপকারিতাও হতে পারে। নিচে মসুর ডালের সম্ভাব্য অপকারিতাগুলো দেওয়া হলো:

  1. গ্যাস ও পেটফাঁপা: মসুর ডালে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা অনেক সময় পেটফাঁপা এবং গ্যাসের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যাদের হজমের সমস্যা রয়েছে, তারা এটি খাওয়ার পর অস্বস্তি বোধ করতে পারেন।

  2. অতিরিক্ত প্রোটিন: মসুর ডাল প্রোটিনের একটি ভালো উৎস, তবে অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে যাদের কিডনির সমস্যা আছে, তারা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এটি বেশি পরিমাণে খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত।

  3. অক্সালেটসের উপস্থিতি: মসুর ডালে অক্সালেটস থাকে, যা কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। যাদের কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি আছে, তাদের জন্য এটি ক্ষতিকর হতে পারে।

  4. লেকটিনের কারণে সমস্যা: কিছু ক্ষেত্রে মসুর ডালে থাকা লেকটিন নামক একটি প্রোটিন শরীরে হজমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যা পরিপাকতন্ত্রে প্রদাহ বা অস্বস্তি ঘটাতে পারে।

  5. আলসার বা পেটের সমস্যা: যাদের আলসার বা পেটের অন্যান্য সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য ডাল জাতীয় খাবার কখনো কখনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

তবে সাধারণত মসুর ডাল পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসাবে বিবেচিত, তাই সঠিক পরিমাণে ও নিয়মিত খেলে এটি বেশিরভাগ মানুষের জন্য নিরাপদ এবং উপকারী।

হাড় এবং দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখায় মসুর ডালের গুরুত্ব

মসুর ডাল হাড় এবং দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এতে এমন কিছু পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়ক। এর মধ্যে প্রধান উপাদানগুলো হলো:

1. ক্যালসিয়াম:

মসুর ডালে ক্যালসিয়াম থাকে, যা হাড় এবং দাঁতের গঠন ও মজবুতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যালসিয়াম হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং হাড় দুর্বল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়। দাঁতের এনামেল শক্ত রাখার জন্যও ক্যালসিয়াম প্রয়োজন।

2. ফসফরাস:

ফসফরাস হাড়ের গঠন ও পুনর্গঠনে ক্যালসিয়ামের সাথে কাজ করে। মসুর ডালে ফসফরাসের উপস্থিতি হাড়কে শক্তিশালী এবং স্থিতিস্থাপক রাখে। এটি দাঁতের এনামেলকে মজবুত করতেও সহায়তা করে।

3. ম্যাগনেশিয়াম:

ম্যাগনেশিয়াম ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে, যা হাড় এবং দাঁতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং হাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।

4. প্রোটিন:

মসুর ডাল প্রোটিনের ভালো উৎস, যা হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে। প্রোটিন হাড়ের টিস্যুর মেরামত ও পুনর্গঠনে সহায়ক। হাড়ের গঠন এবং শক্তি বাড়াতে প্রোটিন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

5. ফোলেট (ভিটামিন B9):

ফোলেট নতুন কোষ গঠনে সহায়তা করে এবং হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি হাড় দুর্বল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।

6. অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস:

মসুর ডালে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস ফ্রি র‌্যাডিক্যাল ক্ষতি থেকে শরীরকে রক্ষা করে, যা হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।

সুতরাং, মসুর ডাল নিয়মিত খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য উপকারী।

ওজন কমাতে মসুর ডালের গুরুত্ব

মসুর ডাল ওজন কমাতে অত্যন্ত উপকারী একটি খাবার, কারণ এতে প্রচুর পুষ্টিগুণ রয়েছে যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এর বিভিন্ন উপাদান ও বৈশিষ্ট্য ওজন কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নিচে মসুর ডালের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:

1. প্রচুর প্রোটিন:

মসুর ডালে উচ্চমাত্রার প্রোটিন থাকে, যা শরীরে পেশির গঠন বজায় রাখতে সহায়তা করে। প্রোটিন ধীরে হজম হয় এবং দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে, ফলে ক্ষুধার অনুভূতি কম হয় এবং অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমে।

2. ফাইবারের ভালো উৎস:

মসুর ডালে থাকা ফাইবার হজম প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়, ফলে দীর্ঘ সময় পেট ভরা থাকে এবং ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফাইবার পেটফাঁপা ও গ্যাসের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে এবং শরীরের ফ্যাট শোষণ কমাতে সহায়ক।

3. লো ক্যালোরি:

মসুর ডাল ক্যালোরিতে কম কিন্তু পুষ্টিতে সমৃদ্ধ, যা ওজন কমানোর জন্য উপযুক্ত। এটি খেলে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় কিন্তু অতিরিক্ত ক্যালোরি জমা হয় না। ফলে শরীরের ফ্যাট পোড়ানোর প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।

4. লো ফ্যাট:

মসুর ডালে চর্বি বা ফ্যাটের পরিমাণ খুব কম থাকে, যা ওজন কমাতে সহায়ক। চর্বি কম খাবার খেলে শরীরে ফ্যাট জমা হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।

5. রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ:

মসুর ডাল গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) কম একটি খাবার, অর্থাৎ এটি ধীরে ধীরে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়। এর ফলে ইনসুলিনের হঠাৎ পরিবর্তন হয় না, যা ওজন বাড়ানোর অন্যতম কারণ। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা ওজন কমাতে সহায়ক।

6. সাধারণ খাবার ও সহজলভ্য:

মসুর ডাল সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য, যা বিভিন্ন উপায়ে রান্না করা যায়। এটি খেতে সুস্বাদু এবং অন্যান্য খাদ্য উপাদানের সাথে সহজে মিশিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্যকারী ডায়েট তৈরি করা যায়।

7. মেটাবলিজম বৃদ্ধি করে:

মসুর ডালে থাকা পুষ্টিগুণ শরীরের মেটাবলিজম বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে, যা ফ্যাট বার্নিংয়ের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। ফলে ওজন কমানোর গতি বাড়ে।

সুতরাং, মসুর ডাল ওজন কমাতে একটি পুষ্টিকর ও কার্যকর খাদ্য। এটি সঠিক ডায়েটের অংশ হিসেবে গ্রহণ করলে ওজন নিয়ন্ত্রণে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

মসুর ডাল উৎপাদন ও সংরক্ষন পদ্ধতি

মসুর ডাল বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি জনপ্রিয় খাদ্যশস্য, যা চাষ ও সংরক্ষণের নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে উৎপাদিত ও সংরক্ষিত হয়। মসুর ডালের সঠিক উৎপাদন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি নিশ্চিত করলে ভালো ফলন পাওয়া যায় এবং ডাল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। নিচে মসুর ডালের উৎপাদন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি তুলে ধরা হলো:

১. মসুর ডালের উৎপাদন পদ্ধতি:

জমি প্রস্তুতি:

  • জমি নির্বাচন: মসুর ডাল উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমিতে ভালো হয়। হালকা দোআঁশ মাটি বা বেলে দোআঁশ মাটি মসুর ডাল চাষের জন্য উত্তম।
  • জমি চাষ: জমি প্রস্তুতির জন্য ২-৩ বার চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হয়। জমিতে আগাছা পরিষ্কার করে মাটি সুষম করতে হবে।
  • জমির জলনিকাশি ব্যবস্থা: মসুর ডাল জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না, তাই জমিতে ভালো ড্রেনেজ সিস্টেম থাকতে হবে।

বীজ বপন:

  • বীজের পরিমাণ: প্রতি হেক্টরে ৩০-৪০ কেজি বীজ বপন করা হয়।
  • বীজ বপনের সময়: সাধারণত কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে (অক্টোবর-নভেম্বর) বপন করা হয়।
  • বীজ শোধন: রোগমুক্ত বীজ নিশ্চিত করতে ৩-৫ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম বা থাইরাম দিয়ে বীজ শোধন করা উচিত।
  • বীজ বপন পদ্ধতি: বীজ সরাসরি বপন করা হয়, তবে কায়েক পদ্ধতিতে বপন করা যেতে পারে, যেমন ছিটিয়ে বা সারিতে বপন। সারিতে বপন করলে গাছের যত্ন ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।

সার প্রয়োগ:

  • সারের ধরন ও পরিমাণ: মসুর ডাল উৎপাদনে সাধারণত জৈব সার (কম্পোস্ট), ইউরিয়া, টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট), এবং এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সার ব্যবহার করা হয়। প্রতি হেক্টরে ৩০-৪০ কেজি নাইট্রোজেন, ২০-২৫ কেজি ফসফরাস এবং ১৫-২০ কেজি পটাশ প্রয়োগ করতে হয়।

সেচ ও আগাছা দমন:

  • সেচ: মসুর ডাল সাধারণত শুষ্ক জমিতে চাষ করা হয়, তবে প্রয়োজনে একবার সেচ দেওয়া যেতে পারে, বিশেষ করে ফুল ফোটার সময়।
  • আগাছা দমন: আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য ম্যানুয়াল বা যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। আগাছা থাকলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়।

রোগ ও পোকা দমন:

  • রোগ: মসুর ডালের প্রধান রোগগুলোর মধ্যে উজ্জ্বল দাগ, উইল্ট এবং গ্রীন ভাইরাস অন্যতম। এ জন্য বালাইনাশক স্প্রে করা যেতে পারে।
  • পোকা দমন: পোকামাকড় আক্রমণ হলে কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে জৈব পদ্ধতি যেমন ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করাও উপকারী।

ফসল সংগ্রহ:

  • ফসল কাটা: মসুর ডাল সাধারণত বপনের ১০০-১১০ দিনের মধ্যে কাটা যায়। গাছের পাতা হলুদ হয়ে এলে এবং শুঁটি শুকিয়ে গেলে ফসল কাটার উপযুক্ত সময়।
  • শুকানো ও মাড়াই: ফসল কাটার পর গাছ শুকিয়ে নিয়ে মাড়াই করতে হয়। শুঁটি ফেটে ডাল বের করে রোদে ভালোভাবে শুকানো উচিত।

২. মসুর ডালের সংরক্ষণ পদ্ধতি:

শুকানো:

  • মসুর ডাল দীর্ঘদিন ভালো রাখতে চাইলে শুকানোর প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডালকে ভালোভাবে রোদে শুকাতে হবে যাতে এতে আর্দ্রতা ১২%-এর কম থাকে। আর্দ্রতা বেশি থাকলে ডাল পচে যেতে পারে বা পোকা ধরতে পারে।

সংরক্ষণ পাত্র:

  • হাওয়া প্রতিরোধক পাত্র: মসুর ডাল সংরক্ষণের জন্য বায়ু প্রতিরোধী পাত্র ব্যবহার করা উচিত, যেমন প্লাস্টিকের ড্রাম, মেটাল কন্টেইনার বা হাওয়া প্রতিরোধক ব্যাগ।
  • নিমপাতা বা শুকনো লং ব্যবহার: ডালে পোকা লাগার ঝুঁকি কমাতে পাত্রে নিমপাতা বা শুকনো লং রাখতে পারেন, যা প্রাকৃতিকভাবে কীটপতঙ্গ দূরে রাখে।

ঠাণ্ডা ও শুকনো স্থান:

  • মসুর ডাল শুষ্ক এবং ঠাণ্ডা স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। উচ্চ তাপমাত্রা বা আর্দ্র পরিবেশে সংরক্ষণ করলে ডাল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

রোগবালাই প্রতিরোধ:

  • সংরক্ষণের সময় ডালে পোকা বা ফাঙ্গাস ধরলে প্রয়োজনে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। তবে বালাইনাশক ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, যেন খাদ্য সুরক্ষিত থাকে।

এই পদ্ধতিগুলো মেনে চললে মসুর ডাল সঠিকভাবে উৎপাদিত ও সংরক্ষিত হয়ে দীর্ঘদিন ভালো থাকবে এবং পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url