চোখের আঞ্জনি হওয়ার কারণ ও প্রতিরোধের উপায়
সূচিপত্রঃ চোখের আঞ্জনি হওয়ার কারণ ও প্রতিরোধের উপায়
চোখে আঞ্জনি কি কারণে হয় ?
চোখে আঞ্জনি (যাকে ইংরেজিতে stye বলা হয়) সাধারণত চোখের পাপড়ির গোড়ায় অবস্থিত তেলগ্রন্থির সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। আঞ্জনি মূলত একটি ছোট ফোলা, লালচে বা পুঁজভরা গুটি হিসেবে দেখা দেয়, যা চোখে অস্বস্তি বা ব্যথা তৈরি করতে পারে। আঞ্জনি হওয়ার কিছু সাধারণ কারণ হল:
- ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ: সাধারণত স্ট্যাফাইলোকক্কাস (Staphylococcus) নামে পরিচিত ব্যাকটেরিয়া আঞ্জনির প্রধান কারণ।
- চোখ ঘষা: অস্বাস্থ্যকর হাতে চোখ ঘষলে ব্যাকটেরিয়া ত্বকে ঢুকে আঞ্জনি তৈরি করতে পারে।
- তেল গ্রন্থি বন্ধ হয়ে যাওয়া: চোখের পাতার তেল গ্রন্থি (Meibomian gland) বন্ধ হয়ে গেলে সেখান থেকে সংক্রমণ হতে পারে।
- ময়লা বা মেকআপ জমা হওয়া: চোখে জমে থাকা ময়লা, পুরানো মেকআপ বা অপরিষ্কার লেন্স ব্যবহারের কারণে আঞ্জনি হতে পারে।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব: নিয়মিত চোখ পরিষ্কার না রাখা বা ধুলাবালি থেকে চোখ রক্ষা না করার কারণে সংক্রমণ হতে পারে।
- চোখের অন্যান্য সমস্যা: কিছু ক্ষেত্রে চোখের অন্যান্য সমস্যা যেমন ব্লেফারাইটিস (চোখের পাতায় প্রদাহ) থেকে আঞ্জনি হতে পারে।
যদিও আঞ্জনি সাধারণত ক্ষতিকারক নয় এবং কয়েক দিনের মধ্যে নিজে নিজেই সেরে যায়, তবে চোখে দীর্ঘস্থায়ী বা গুরুতর সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।
চোখে আঞ্জনি হওয়া থেকে দুরে থাকার উপায় ?
চোখে আঞ্জনি হওয়া থেকে দূরে থাকার জন্য কিছু নিয়মিত অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার যা সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করবে। নিচে কিছু কার্যকর উপায় দেওয়া হলো:
১. চোখ পরিষ্কার রাখা:
- প্রতিদিন সকালে ও রাতে মুখ এবং চোখ ভালোভাবে পরিষ্কার করা জরুরি। বিশেষ করে চোখের পাপড়ির গোড়ায় জমে থাকা তেল, ময়লা বা মেকআপ পরিষ্কার করতে হবে।
- মেকআপ সরানোর জন্য অ্যান্টিসেপটিক বা মাইল্ড আই ক্লিনজার ব্যবহার করুন।
২. হাত পরিষ্কার রাখা:
- চোখে হাত দেওয়ার আগে সবসময় হাত ধুয়ে পরিষ্কার রাখুন।
- হাত ময়লা থাকলে চোখে হাত না দেওয়ার চেষ্টা করুন, কারণ এতে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে।
৩. ব্যক্তিগত আইটেম শেয়ার না করা:
- কারও সাথে তোয়ালে, চোখের মেকআপ, কন্টাক্ট লেন্স বা অন্য কোনো ব্যক্তিগত জিনিস শেয়ার করা এড়িয়ে চলুন।
৪. চোখে মেকআপ পরিষ্কার করা:
- রাতে ঘুমানোর আগে চোখের মেকআপ (মাসকারা, আইলাইনার) ভালোভাবে মুছে ফেলুন, কারণ এগুলো চোখের তেল গ্রন্থি বন্ধ করে দিতে পারে।
- প্রাচীন বা এক্সপায়ারড মেকআপ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
৫. চোখে কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহারে সতর্কতা:
- কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহারের আগে ও পরে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন।
- লেন্স সবসময় পরিষ্কার রাখুন এবং ব্যবহারের পর লেন্স সঠিকভাবে সংরক্ষণ করুন।
৬. চোখে ধুলাবালি থেকে রক্ষা করুন:
- বাইরে যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় হলে সানগ্লাস বা সুরক্ষামূলক চশমা ব্যবহার করুন যাতে চোখে ধুলাবালি বা অন্যান্য অশুদ্ধি না ঢোকে।
৭. স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ:
- ভিটামিন A, C, এবং E সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন যা চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি ও ফল খান।
৮. চোখে ঘষা এড়িয়ে চলুন:
- চোখে যদি চুলকানি বা অস্বস্তি অনুভূত হয়, তবে হাত দিয়ে ঘষা বা ঘাঁটা এড়িয়ে চলুন, কারণ এতে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
৯. নিয়মিত চোখের চিকিৎসা:
- চোখের কোনো সমস্যা হলে বা বারবার আঞ্জনি হলে চোখের ডাক্তার দেখানো উচিত। কোনো গুরুতর সমস্যা আগে থেকেই নির্ণয় করে চিকিৎসা করা ভালো।
১০. স্ট্রেস কমানো:
- মানসিক চাপ (স্ট্রেস) চোখের সমস্যার কারণ হতে পারে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও মানসিক চাপ কমানোর জন্য রিল্যাক্সেশন টেকনিকস (যেমন মেডিটেশন, যোগব্যায়াম) অনুসরণ করতে পারেন।
এই নিয়মগুলো মেনে চললে আঞ্জনি হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমানো সম্ভব। তবে যদি কোনো কারণে আঞ্জনি হয়েও যায়, তখন দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করে সেটি নিরাময় করা জরুরি।
আঞ্জনি ভালো করার ঘরোয়া উপায় ?
আঞ্জনি দ্রুত ভালো করার জন্য কিছু ঘরোয়া ও চিকিৎসাগত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। নিচে আঞ্জনি নিরাময়ের জন্য কিছু কার্যকর কৃত্রিম উপায় দেওয়া হলো:
১. গরম পানির সেঁক:
- একটি পরিষ্কার কাপড় গরম পানিতে ভিজিয়ে আঞ্জনির ওপর ৫-১০ মিনিটের জন্য রাখুন।
- দিনে ৩-৪ বার এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে ফোলাভাব ও ব্যথা কমতে সাহায্য করবে এবং পুঁজ দ্রুত বের হতে সাহায্য করবে।
২. চোখ পরিষ্কার রাখা:
- আঞ্জনি থাকাকালীন চোখ সবসময় পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করুন।
- হালকা মাইল্ড বেবি শ্যাম্পু বা অ্যান্টিসেপটিক ক্লিনজার দিয়ে চোখ ধুতে পারেন। চোখের মেকআপ এড়িয়ে চলুন।
আরো পড়ুনঃ প্রতিদিন সকালে আদা খাওয়ার উপকারিতা
৩. ওষুধযুক্ত মলম:
- ডাক্তার পরামর্শ দিলে অ্যান্টিবায়োটিক আই মলম বা ড্রপ ব্যবহার করতে পারেন, যা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক।
- সাধারণত Erythromycin বা Tobramycin আই মলম দেওয়া হয়ে থাকে।
৪. ব্যথা ও ফোলাভাব কমানোর জন্য ওষুধ:
- ইবুপ্রোফেন বা প্যারাসিটামল জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যেতে পারে, যা ব্যথা ও ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করবে।
৫. চোখে মেকআপ ব্যবহার বন্ধ করুন:
- আঞ্জনি হওয়ার সময় এবং সম্পূর্ণ সেরে না ওঠা পর্যন্ত চোখে মেকআপ বা কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার বন্ধ রাখুন, কারণ এগুলো সংক্রমণ আরও বাড়াতে পারে।
৬. চোখ ঘষা এড়িয়ে চলুন:
- আঞ্জনি হলে চোখে হাত দেওয়া বা ঘষা এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৭. চিকিৎসকের পরামর্শ:
- যদি আঞ্জনি ১-২ সপ্তাহের মধ্যে না সারে বা বারবার হয়, তবে অবশ্যই ডাক্তার দেখানো উচিত। ডাক্তার প্রয়োজনে আঞ্জনি থেকে পুঁজ বের করার জন্য ছোট্ট সার্জারি করতে পারেন।
৮. পুষ্টিকর খাবার:
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রচুর পুষ্টিকর খাবার খাওয়া জরুরি। বিশেষ করে ভিটামিন A, C, এবং E সমৃদ্ধ খাবার আঞ্জনি দ্রুত সারাতে সাহায্য করতে পারে।
এগুলো সাধারণত আঞ্জনি সারানোর কার্যকর উপায়। তবে যদি আঞ্জনি গুরুতর হয় বা একাধিকবার হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
আঞ্জনি ভালো করার ক্রিম
চোখের আঞ্জনি (Stye) ভালো করার জন্য বেশ কিছু অ্যান্টিবায়োটিক বা প্রদাহনাশক মলম ও ক্রিম পাওয়া যায়, যা চোখের সংক্রমণ ও প্রদাহ কমাতে সহায়ক। তবে এগুলো ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। নিচে কয়েকটি প্রচলিত ক্রিমের নাম দেওয়া হলো:
১. ইরিথ্রোমাইসিন আই অয়েন্টমেন্ট (Erythromycin Eye Ointment):
- এটি একটি অ্যান্টিবায়োটিক মলম, যা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং আঞ্জনি ভালো হতে সাহায্য করে।
- চোখের আঞ্জনি বা অন্যান্য সংক্রমণজনিত সমস্যার জন্য চিকিৎসকরা এটি প্রায়ই পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
২. টোব্রামাইসিন আই অয়েন্টমেন্ট (Tobramycin Eye Ointment):
- এই অ্যান্টিবায়োটিক মলমটি চোখের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ সারাতে কার্যকর।
- সাধারণত চোখে আঞ্জনি বা কনজাংটিভাইটিসের জন্য ব্যবহার করা হয়।
৩. ব্যাসিট্রাসিন পলিমাইক্সিন বি আই অয়েন্টমেন্ট (Bacitracin-Polymyxin B Eye Ointment):
- এটি একটি মিশ্র অ্যান্টিবায়োটিক ক্রিম যা আঞ্জনির সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে।
- এটি সংক্রমণ রোধ করে এবং চোখের প্রদাহ কমায়।
৪. হাইড্রোকরটিসন আই মলম (Hydrocortisone Eye Ointment):
- এটি একটি প্রদাহনাশক মলম, যা ফোলাভাব ও লালভাব কমাতে সাহায্য করে। তবে এটি শুধুমাত্র ডাক্তার নির্দেশিত হলে ব্যবহার করা উচিত, কারণ এটি কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
৫. অফথ্যালমিক অ্যান্টিবায়োটিক আই ড্রপস (Ophthalmic Antibiotic Drops):
- কিছু ক্ষেত্রে আঞ্জনি দ্রুত সারানোর জন্য আই ড্রপ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়, যা চোখের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
ব্যবহার নির্দেশিকা:
- মলম বা ড্রপ ব্যবহার করার আগে হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
- প্রতিদিন ২-৩ বার বা ডাক্তার নির্দেশিত সময় অনুযায়ী মলম প্রয়োগ করতে হবে।
- চোখে মেকআপ ব্যবহার করা এড়িয়ে চলতে হবে এবং কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার না করাই উত্তম।
এ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক মলম বা ক্রিম আঞ্জনি দ্রুত নিরাময় করতে সাহায্য করে। তবে দীর্ঘস্থায়ী বা জটিল আঞ্জনি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url