বাচ্চাদের দাত উঠার সময় করনীয়-- দাঁত না উঠার কারন
সূচিপত্রঃ বাচ্চাদের দাত উঠার সময় করনীয়-- দাত না উঠার কারন
কতদিন বয়স হলে বাচ্চাদের দাঁত বের হতে শুরু হয়?
আরো পড়ুনঃ মানসিক স্বাস্থ ভালো রাখার উপায়
বাচ্চাদের দাঁতের যত্ন নেওয়ার উপায়?
১. শুরু থেকেই দাঁতের যত্নঃ
- বাচ্চার প্রথম দাঁত ওঠার সাথে সাথে দাঁত মুছে দেওয়া উচিত। নরম একটি কাপড় বা গজ কাপড় দিয়ে দাঁত এবং মাড়ি আলতোভাবে মুছে পরিষ্কার করা উচিত।
- বাচ্চার দাঁত ওঠার পর, শিশুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি ছোট ব্রাশ ব্যবহার করে দিনে দুবার দাঁত ব্রাশ করতে শুরু করুন।
২. নিয়মিত ব্রাশ করাঃ
- প্রথম দাঁত বের হওয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই দিনে অন্তত দুবার (সকালে এবং ঘুমানোর আগে) নরম ব্রিসলযুক্ত শিশুদের টুথব্রাশ এবং ফ্লুরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করে দাঁত ব্রাশ করতে দিন।
- প্রথম দিকে খুব অল্প পরিমাণ টুথপেস্ট ব্যবহার করুন (ভাতের দানা পরিমাণ)। বাচ্চার বয়স ৩ বছর হলে এটি মটর দানা পরিমাণে বাড়িয়ে নিন।
- নিশ্চিত করুন যে বাচ্চা ব্রাশ করার পরে টুথপেস্ট গিলে না ফেলে, বরং থুতু ফেলে দেয়।
৩. সঠিক খাদ্যাভ্যাসঃ
- খুব বেশি চিনি বা মিষ্টি খাবার বাচ্চার দাঁতের ক্ষতির প্রধান কারণ হতে পারে। তাই বাচ্চাকে বেশি চিনি এবং মিষ্টি খাবার এড়াতে উৎসাহিত করুন।
- স্বাস্থ্যকর খাবার যেমন ফল, সবজি, দুধ এবং দই খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, যা দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
- চিনি যুক্ত পানীয় যেমন সফট ড্রিঙ্কস বা ফলের রস বেশি পরিমাণে পান করানো এড়িয়ে চলুন।
৪. বোতল ব্যবহারে সতর্কতাঃ
- ঘুমানোর সময় শিশুর মুখে বোতল রেখে ঘুমাতে দেওয়া উচিত নয়। দুধ বা রস থেকে চিনি দাঁতে লেগে ক্যাভিটি হতে পারে।
- বাচ্চার ১ বছর বয়সের পর বোতলের পরিবর্তে সিপি কাপ বা খোলসা কাপ ব্যবহার শুরু করা উচিত।
৫. ডেন্টাল ভিজিটঃ
- শিশুর প্রথম জন্মদিনের মধ্যে অথবা প্রথম দাঁত বের হওয়ার পরপরই একজন পেডিয়াট্রিক ডেন্টিস্টের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
- নিয়মিত ডেন্টাল চেকআপ করানো গুরুত্বপূর্ণ, যাতে কোনো সমস্যা থাকলে তা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে এবং সমাধান করা যায়।
৬. নিয়মিত ফ্লুরাইড ব্যবহারঃ
- ফ্লুরাইড দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে। নিশ্চিত করুন যে আপনার বাচ্চা ফ্লুরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করছে।
- যদি আপনার এলাকার পানিতে ফ্লুরাইড না থাকে, তাহলে ডাক্তার বা ডেন্টিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী ফ্লুরাইড সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
৭. বাচ্চার দাঁত ব্রাশ করার সময় তত্ত্বাবধানঃ
- যতক্ষণ না পর্যন্ত বাচ্চা নিজে ঠিকমত দাঁত ব্রাশ করতে শিখছে, ততদিন পিতা-মাতা বা অভিভাবকরা তত্ত্বাবধান করা জরুরি।
বাচ্চাদের দাঁত না উঠার কারণ?
১. জেনেটিক ফ্যাক্টর (জিনগত কারণ):
- পরিবারের মধ্যে দাঁত উঠতে দেরি হওয়ার ইতিহাস থাকলে, বাচ্চার ক্ষেত্রেও দাঁত উঠতে দেরি হতে পারে।
- এটি মূলত জিনগত বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত, যা বংশপরম্পরায় চলে আসতে পারে।
২. অপ্রতুল পুষ্টি (পুষ্টির অভাব):
- ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, এবং ভিটামিন D এর অভাব হলে দাঁতের গঠন ও বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে।
- সঠিক পুষ্টি না পেলে দাঁতের এনামেল গঠন হতে দেরি হয়, যা দাঁত না ওঠার কারণ হতে পারে।
৩. পূর্বাবস্থায় সময়ের আগেই জন্মগ্রহণ করা (প্রিম্যাচিওর বার্থ):
- যেসব শিশুরা নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্মগ্রহণ করে, তাদের শারীরিক বিকাশের ধীরগতি হতে পারে, যার ফলে দাঁত উঠতেও সময় লাগতে পারে।
৪. হরমোনজনিত সমস্যাঃ
- কিছু হরমোনজনিত অসুখ যেমন হাইপোথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের অভাব) দাঁতের বিকাশে দেরি করতে পারে।
- এমন ক্ষেত্রে শিশু বিশেষজ্ঞ বা এন্ডোক্রিনোলজিস্টের সাথে পরামর্শ করা জরুরি।
৫. গর্ভাবস্থায় মায়ের স্বাস্থ্যঃ
- গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টির অভাব, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বা অন্য স্বাস্থ্য সমস্যা শিশুর দাঁত ওঠার সময়ে প্রভাব ফেলতে পারে।
৬. ক্র্যানিওফেসিয়াল ডিজঅর্ডারঃ
- কিছু নির্দিষ্ট জন্মগত অবস্থা যেমন ক্লেফট প্যালেট বা ডাউন সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে দাঁত ওঠার সময়ে দেরি হতে পারে।
৭. মেডিকেশন ও স্বাস্থ্য সমস্যাঃ
- যদি শিশুর কোনো দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা বা শারীরিক সমস্যা থাকে, যেমন অস্টিওপেট্রোসিস বা রিকেটস, তবে দাঁত ওঠার সময় দেরি হতে পারে।
৮. অত্যধিক ফ্লুরাইড গ্রহণঃ
- ফ্লুরাইডের অতিরিক্ত মাত্রা দাঁতের গঠনে প্রভাব ফেলতে পারে, যা দাঁত না উঠার একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।
করণীয়ঃ
- যদি আপনার বাচ্চার ১২-১৪ মাস বয়সেও দাঁত না ওঠে, তবে উদ্বিগ্ন না হয়ে অপেক্ষা করতে পারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি স্বাভাবিক।
- ১৮ মাসের পরও দাঁত না উঠলে শিশু বিশেষজ্ঞ বা শিশুদের দাঁতের ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা, ভিটামিন D এবং ক্যালসিয়ামের পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্রহণ করা, এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো দরকার।
এভাবে দেরিতে দাঁত ওঠার কারণগুলো পর্যবেক্ষণ করলে এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিলে বাচ্চার দাঁতের সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব।
বাচ্চাদের দাঁতে পোকা লাগার কারণ ও সমাধান
১. অতিরিক্ত চিনি গ্রহণঃ
- মিষ্টি খাবার ও পানীয় যেমন চকলেট, ক্যান্ডি, কেক, বিস্কুট, সফট ড্রিঙ্ক, এবং ফলের রসে থাকা চিনি দাঁতে পোকা লাগার প্রধান কারণ।
- চিনি দাঁতের ব্যাকটেরিয়ার জন্য একটি প্রধান খাদ্য উপাদান, যা অ্যাসিড তৈরি করে দাঁতের ক্ষয় ঘটায়।
২. খাদ্যকণা মুখে রেখে দেওয়াঃ
- খাবার খাওয়ার পরে মুখ ভালোভাবে পরিষ্কার না করলে খাদ্যকণা দাঁতে লেগে থাকে, যা ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে এসে ক্যাভিটি সৃষ্টি করতে পারে।
- বিশেষ করে রাতের বেলা দাঁত ব্রাশ না করা বা ব্রাশ করার পর চিনি বা মিষ্টি কিছু খাওয়া দাঁতের জন্য ক্ষতিকর।
৩. সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ না করাঃ
- অনিয়মিত বা সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ না করার ফলে দাঁতের ফাঁকে খাদ্যকণা জমে থাকে, যা পোকা লাগার কারণ হতে পারে।
- বাচ্চারা অনেক সময় দাঁত ব্রাশ করতে গিয়ে সমস্ত দাঁত ভালোভাবে পরিষ্কার করতে পারে না, বিশেষ করে পেছনের দাঁতগুলোতে সমস্যা বেশি হয়।
৪. দাঁতের গঠনঃ
- কিছু বাচ্চার দাঁত প্রাকৃতিকভাবে আরও বেশি গভীর খাঁজ বা ফাঁকযুক্ত হতে পারে, যেখানে খাদ্যকণা জমা হয় এবং পোকা লাগে।
- দাঁতের গঠনের কারণে সেসব ফাঁকগুলো পরিষ্কার করা কঠিন হয়।
৫. বোতলে দুধ বা রস পান করানোঃ
- ঘুমানোর সময় শিশুর মুখে বোতল রেখে দিলে মুখের মধ্যে দুধ বা ফলের রস জমে যায়, যা দাঁতের ক্ষয় করতে পারে। একে "বোতল ক্যারিজ" বলা হয়।
- দুধ এবং ফলের রসে থাকা প্রাকৃতিক চিনি দাঁতের এনামেল নষ্ট করে দেয়।
৬. ফ্লুরাইডের অভাবঃ
- ফ্লুরাইড দাঁতের এনামেলকে মজবুত করে এবং ক্যাভিটি রোধ করে।
- ফ্লুরাইডযুক্ত টুথপেস্ট বা পানিতে ফ্লুরাইড না থাকলে ক্যাভিটির ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৭. শুষ্ক মুখ (Saliva কম উৎপাদন):
- লালা (saliva) দাঁত থেকে খাদ্যকণা ও অ্যাসিড পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। মুখ শুষ্ক থাকলে লালার পরিমাণ কমে যায়, ফলে দাঁতের ক্ষয় হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
প্রতিরোধের উপায়ঃ
- বাচ্চাদের দাঁত দিনে দুবার ফ্লুরাইডযুক্ত টুথপেস্ট দিয়ে ব্রাশ করানো।
- খুব মিষ্টি খাবার বা পানীয় থেকে বিরত থাকা।
- নিয়মিত ডেন্টাল চেকআপ করানো।
- ফ্লুরাইডযুক্ত পানীয় ব্যবহার করা এবং প্রয়োজনে ফ্লুরাইড সাপ্লিমেন্ট দেওয়া।
এই কারণগুলোর উপর নজর রাখলে এবং সঠিকভাবে দাঁতের যত্ন নিলে বাচ্চাদের দাঁতে পোকা লাগার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।
কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url